
জুয়ায় আর্থিক লেনদেনের সহজ মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে বাংলাদেশি মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস)। সবচেয়ে অবাক করা বিষয়, রাশিয়া থেকে পরিচালিত জুয়ার সাইট বেটউইনার ও ওয়ানএক্সবেটসহ একাধিক সাইটে বাংলাদেশিদের লেনদেনের জন্য মোবাইল ব্যাংকিং বিকাশ, নগদ, রকেট ও উপায় যুক্ত। এছাড়া রয়েছে ব্যাংকের মাধ্যমেও পেমেন্ট করার সুযোগ। ব্যাংক এশিয়া, ব্র্যাক ব্যাংক, সিটি ব্যাংক, ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেড ও ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে লেনদেন করা যায় এসব সাইটে।
জুয়া খেলা বেশি করে সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিতে ফেসবুক ব্যবহারকারীদের টার্গেট করে জুয়ার সাইটের বিজ্ঞাপন দেওয়া হচ্ছে বাংলায়। অনলাইন ক্যাসিনোর অ্যাপস ইনস্টলের জন্যও দেওয়া হচ্ছে বিভিন্ন অফার। এমনকি বিজ্ঞাপনে বাংলাদেশের বিভিন্ন সেলিব্রিটির ছবিও দেখা যাচ্ছে।
কয়েকটি ক্যাসিনোর ফেসবুক পেজে দেওয়া রয়েছে হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর। এগুলোয় যোগাযোগ করেও তেমন কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। বরং টাকার বিনিময়ে গ্রুপের সদস্য হওয়ার শর্ত দেওয়া হয়েছে। চাওয়া হয়েছে জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর, নাম, বয়স, জন্মতারিখ ও মোবাইল নম্বর। এসব তথ্য দিলেই মেলে গ্রুপের সদস্য হওয়ার অনুমতি।
জুয়ার সাইট বন্ধ করেও মিলছে না সমাধান। ২০১৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) এক বিজ্ঞপ্তিতে অনলাইনে জুয়া খেলার ১৭৬টি সাইট বন্ধ করার কথা বলা হয়। ২০২২ সালে এসে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে দেশে অনলাইনে জুয়া খেলার প্রবণতা বাড়ছে বলে জানিয়ে তা বন্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি।
২০২২ সালের ১০ অক্টোবর ৩৩১টি অনলাইন জুয়ার সাইট বন্ধ করে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা সেল’। সেলটির নিয়মিত নজরদারির অংশ হিসেবে এসব অবৈধ সাইট বন্ধ করা হয়। এছাড়া আন্তর্জাতিক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান সার্চ ইঞ্জিন ‘গুগল’ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে অনলাইন জুয়া বা বাজি-সংক্রান্ত ১৫০টি গুগল অ্যাপস বন্ধের জন্য রিপোর্ট করা হলে এরই মধ্যে গুগল কর্তৃপক্ষ প্লে স্টোর থেকে ১৪টি অ্যাপস বন্ধ করেছে এবং অবশিষ্ট অ্যাপস বন্ধের জন্য যাচাই-বাছাইসহ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছে।
অনলাইনে জুয়া খেলেন বা বাজি ধরেন, এমন কয়েকজনের সঙ্গে আমি সরাসরি কথা বলেছি। তারা বলেন, দেশে এই মুহূর্তে সবচেয়ে জনপ্রিয় অনলাইন জুয়ার সাইট ওয়ানএক্সবেট । এছাড়া বেটউইনার, বেট৩৬৫, মেলবেট, প্যারিম্যাচ সাইটও বেশ জনপ্রিয়। এগুলোর বিজ্ঞাপন নিয়মিত দেওয়া হয় ফেসবুকে। দেশের বাইরে থেকে পরিচালিত এ সাইটগুলোয় ফুটবল, ক্রিকেটসহ বিভিন্ন খেলা নিয়ে বাজি ধরা যায়। ক্রিকেটে প্রতি বলে বলে, ম্যাচের প্রথম ওভারের প্রথম বলে, প্রতি ওভারে, প্রতি ম্যাচের প্রথম ছয় ওভার, পরবর্তী ওভারে উইকেট যাবে কি না এবং কোন দল জিতবে—এমন করে জুয়ার ক্যাটেগরি সাজানো হয়েছে।
গত জুন মাসে বাংলাদেশ-আফগানিস্তান ক্রিকেট খেলায় অ্যাপে বাংলাদেশ উইন ওয়ান ও আফগানিস্তান উইন টু অপশন থাকে। বাজিতে অংশ নিতে অ্যাকাউন্টে এক হাজার টাকা জমা রাখতে বলা হয়। খেলায় বাংলাদেশের রেটিং ছিল ১.৪৪। অর্থাৎ বাংলাদেশের হয়ে খেলে জয় লাভ করলে এক হাজার ৪৪০ টাকা পাওয়া যাবে। জমা রাখা এক হাজার টাকা বাদ দিয়ে বাকি ৪৪০ টাকা উত্তোলন করা যাবে। অন্যদিকে আফগানিস্তানের রেটিং ছিল ২.৪৭। অর্থাৎ আফগান জিতলে দলটির পক্ষে বাজি ধরা ব্যক্তি পাবেন দুই হাজার ৪৭০ টাকা। জমা রাখা এক হাজার টাকা বাদ দিয়ে বাকি এক হাজার ৪৭০ টাকা উত্তোলন করা যাবে।
এসব অনলাইন ক্যাসিনো দেশের বাইরে থেকে পরিচালিত হলেও সমন্বয়ের জন্য দেশীয় সিন্ডিকেট রয়েছে, যারা এজেন্ট হিসেবে কাজ করে। তাদের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে ফেসবুক গ্রুপ বা পেজ খুলে প্রচার চালানো হচ্ছে।
মূলত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ, আইপিএল, বিগব্যাশ, ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ ও বিভিন্ন ঘরোয়া ও আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টের ম্যাচগুলোয় চলে অনলাইনে জুয়ার আসর। জুয়া খেলার জন্য একজন জুয়াড়ি মোবাইল নম্বর বা ইমেইলের মাধ্যমে বেটিং সাইট বা অ্যাপে অ্যাকাউন্ট খোলেন। ওই অ্যাকাউন্টের বিপরীতে একটি ই-ওয়ালেট তৈরি করে ব্যালেন্স যোগ করা হয়। জুয়ার নামে এভাবে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকার লেনদেন হয়। এই জুয়া দেশের গ্রামাঞ্চলে অল্পশিক্ষিত থেকে শুরু করে অর্ধশিক্ষিত মানুষ খেলছেন। অনলাইন জুয়া একটা নেশার মতো, এখানে একবার ঢুকলে নিঃস্ব হওয়া ছাড়া উপায় নেই। অংশগ্রহণকারীরা নিঃস্ব হওয়ায় পারিবারিক সহিংসতা বাড়ছে, আইনশৃঙ্খলার ওপর প্রভাব পড়ছে।
একটি জুয়ার সাইট পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, একসঙ্গে প্রায় এক লাখ বাংলাদেশি জুয়া খেলছে। এর মধ্যে একজন জুয়া খেলে প্রায় এক লাখ ৬৭ হাজার টাকা খুইয়েছেন। এক লাখের মধ্যে যদি ১০ শতাংশ মানুষের ১০ হাজার টাকা করে খোয়া যায়, তাহলে কী পরিমাণ টাকা চলে যাচ্ছে তা উদ্বেগের বিষয়। প্রতিদিন প্রায় তিনশ’র বেশি সাইটে অনলাইন জুয়া খেলা হয়। এর মধ্যে বেশকিছু সাইট বিটিআরসি বন্ধ করেছে।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, অনলাইন জুয়ায় এদেশ থেকে বছরে পাচার হচ্ছে পাঁচ হাজার কোটি টাকার বেশি সম্পদ।
অতিদ্রুত এই অনলাইন জুয়া নামক বিষবৃক্ষকে সমূলে উৎপাটন না করলে এর শাখা-প্রশাখা গজিয়ে স্থায়ী রূপ লাভ করবে। এ বিষয়ে সরকারের দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত।
No comments:
Post a Comment